সেই প্রদীপ লালের ছেলেকে দেওয়া হলো গ্রাম পুলিশের চাকরি

 সেই প্রদীপ লালের ছেলেকে দেওয়া হলো গ্রাম পুলিশের চাকরি

নিহত প্রদীপ লালের ছেলে দুলাল দাসের হাতে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আলম। ছবি-সমকাল

 প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ | ০৪:০৩

রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত মিঠাপুকুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম খামার মকিমপুরের বাসিন্দা ভ্যানচালক প্রদীপ লালের ছেলে দুলাল দাসকে গ্রাম পুলিশের চাকরি দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। সোমবার রাতে নিজ কার্যালয়ে ডেকে তার হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল আলম। 

চাকরি পেয়ে দুলাল দাসসহ ওই পরিবারের সবাই খুশি। নিয়োগপত্র নিয়ে রাত ১০টায় সমকালকে  মোবাইলফোনে কল দিয়ে আনন্দের খবরটি জানান দুলাল দাস। তিনি বলেন, ‘আজ চাকরি পেয়ে খুব ভালো লাগছে। ইউএনও স্যার তার অফিসে ডেকে আমার হাতে চাকরির নিয়োগপত্র দিয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে অথৈ সাগরে পড়ে যাওয়া সংসারটির হাল ধরতে পারবো।’

এসময় দুলালের মা দুলালী রানী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সে (স্বামী প্রদীপ) না থাকায় তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে এক মুঠ ভাতের আশায় অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। আজ সে দুঃখটা ঘুচলো। বাবার অভাব নিয়ে হলেও অভাবের সংসারে সন্তানরা অন্তত খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবে।’ ছেলেকে চাকরি দেওয়ায় মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসনকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন তিনি।

গত ১৮ আগস্ট সমকালে ‘প্রদীপের পরিবারে অন্ধকার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আলম বলেন, ‘নিহত ভ্যানচালক প্রদীপ লাল দাসের ছেলেকে গ্রাম পুলিশের মহলদার হিসেবে নিয়োগ দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। আশা করি তিনি এখন তার হতদরিদ্র পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারবে এবং সততার সঙ্গে ইউনিয়নের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে। যাতে তার বাবার মতো এমন ঘটনার শিকার আর কাউকে হতে না হয়। দুলাল দাস চাকরি শুরু করে মা এবং দুই ভাইবোনের পড়াশোনা ও ভরণপোষণ করবে। সংসারের অভাব একেবারে না কমলেও ধীরে ধীরে কমবে বলে আশা করি।’

পেশায় মুচি ছিলেন প্রদীপ লাল দাস। বছর পাঁচেক আগে পায়ে ঘাসহ ইনফেকশন হলে ডান পায়ের গোড়ালি থেকে কেটে ফেলতে হয়। বসে জুতার কাজও করতে পারতেন না। স্ত্রীসহ তিন ছেলে-মেয়ের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে হয় তাকে। এক সময় অন্যের সহযোগিতায় একটা চার্জার ভ্যান কেনেন। এক পা অকেজো হলেও চার্জার ভ্যান চালাতে সমস্যা হতো না। যার স্বল্প আয়েই চলতো প্রদীপের পাঁচ সদস্যের সংসার।

ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাতেন, অভাবের সংসারেও ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর ধরা দেবেনা কোনোদিন। গত ৯ আগস্ট রাতে রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে যে দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে প্রদীপ লাল একজন। সংসারে স্ত্রীসহ তিন ছেলে-মেয়ে রয়েছে তার। বড় ছেলে দুলাল ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করে বেকার ছিলেন। মেয়ে পলাশী রানী চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে এবং ছোট ছেলে আপন বাবু সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

উল্লেখ্য, তারাগঞ্জের রুপলাল দাসের মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। গত ১০ আগস্ট বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য আগের দিন ৯ আগস্ট মিঠাপুকুরের খামার মকিমপুর থেকে ভাতিজি জামাই প্রদীপ লালকে ডেকে পাঠানো হয়। নিজের ভ্যান চালিয়ে প্রতিবন্ধী প্রদীপ লাল তারাগঞ্জের রুপলাল দাসের বাড়ির দিকে রওনা হন। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন। সেখানে রুপলাল গিয়ে দু’জনে ভ্যানে চড়ে তার ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে আসছিলেন। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দু’জনকে থামান স্থানীয় কয়েকজন। এরপর সেখানে লোক জড়ো হয়ে তাদের মারধর শুরু করেন। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তাদের ফেলে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় তাদের। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ভোররাতে তিনিও মারা যান। 

নবীনতর পূর্বতন

Smartwatchs