জুলাই সনদের খসড়ার প্রথম লাইন তুলে ধরে কড়া আপত্তি জানালেন রাফে সালমান রিফাত



জুলাই সনদের খসড়ার সূচনাতে শুধুই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের একমাত্র ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরার সমালোচনা করেছেন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক শিবির নেতা রাফে সালমান রিফাত। তার মতে, এ জাতির মুক্তির সংগ্রাম শত বছরের পুরোনো। তিনি বলছেন, ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর পাকিস্তান আন্দোলন—সব কিছুর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এসেছে, আর এই দীর্ঘ ইতিহাসকে অস্বীকার করে জুলাই সনদ কোনোভাবেই পূর্ণতা পাবে না।


বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দিবাগত রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ ভ্যারিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট করে তিনি এসব মন্তব্য করেন। 


 পাঠকদের জন্য রাফে সালমান রিফাতের ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা হল: 



জুলাই সনদের খসড়ার একেবারে প্রথম লাইনেই লেখা আছে, “১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি।”


এখানে আমাদের ইতিহাস শুরু করা হয়েছে ১৯৭১ সাল থেকে। অথচ এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মুক্তির আন্দোলন শত বছর পুরোনো। ব্রিটিশদের অধীনে আমরা ২০০ বছর বন্দি ছিলাম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শুরু থেকেই বক্সারের যুদ্ধ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা, ফরায়েজী আন্দোলন, ১৮৫৮ সালের মহাজাগরণ, খেলাফত আন্দোলন, এবং পাকিস্তান আন্দোলনের মতো অসংখ্য মুক্তি সংগ্রাম আমাদের ইতিহাসের অংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এই সংগ্রামগুলোর চেতনা বুকে ধারণ করেই জুলাই অভ্যুত্থানে জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল। 


তাই জুলাই সনদে আমাদের শত বছরের মুক্তির সংগ্রামের উল্লেখ না থাকলে এ সনদ মোটেও পূর্ণতা পাবে না। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের মুক্তি সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। পাকিস্তান আন্দোলনে এই ভূখণ্ডের মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা নানামুখী প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এই ভূখণ্ডের মানুষদের উগ্র হিন্দুত্ববাদের ভয়াল ছোবল থেকে চিরস্থায়ী মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ধাপ। এর মাধ্যমেই আমরা আজকের এই ভূখণ্ড পেয়েছি। ৪৭ না আসলে ৭১ কখনোই আসতো না। আমাদের অবস্থা হতো সিকিম, হায়দ্রাবাদ বা কাশ্মীরের মতো। 



কিন্তু, ফ্যাসিস্ট সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ দেশকে খুশি করতে ‘পাকিস্তানের সৃষ্টি ভুল ছিল’ বয়ান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে গিয়েছে। ৪৭ আর ৭১ কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এরকম অন্তঃসারশূন্য ও মিথ্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত বয়ান ‘অখণ্ড ভারত’ প্রকল্প বাস্তবায়নের সুদীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার এই মিথ্যা বয়ান প্রতিষ্ঠার জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, আমরা যদি এখন সেটিকে ‘ডিকন্সট্রাক্ট’ করে সত্যের প্রচার না করি, তাহলে এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের কৃষ্ণগহ্বর থেকে আমরা বের হতে পারব না। 


“৪৭ ছিল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ধাপ, ৭১ তার চূড়ান্ত ধাপ, ২৪ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটিকে পূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করেছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা।” এই বয়ানই সত্য, এই বয়ানই আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। ১৫ বছরের দিল্লির দাসত্ব শেকল ছাত্র-জনতা যে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ছিন্ন করলো, সেই বিপ্লবের সনদে ৭১ এর পাশাপাশি আমাদের বাকি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তি সংগ্রামের যথোপযুক্ত উল্লেখ থাকা ছাড়া এই সনদ ফ্যাসিস্টদের অখণ্ড ভারতমুখী প্রকল্পেরই একটি এক্সটেনশন হয়ে থাকবে। 


ভুলে গেলে চলবেনা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই শেষ হয়নি, বরং নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। এটি আরও কঠিন; এ পর্বে শত্রুকে দেখা যায়না, শত্রু গুলিও করেনা; বরং মিথ্যা বয়ান, অপসংস্কৃতি আর অপতথ্যের মাধ্যমে আমাদের মগজ ধোলাই করার চেষ্টা করছে। আর এগুলোকে মোকাবেলা করতে হলে আমাদেরকে নির্ভীকচিত্তে সত্য ইতিহাস উদ্‌যাপন করতে হবে। 



খসড়ার সর্বশেষ পয়েন্টে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকার করা হলেও বিপ্লবীদের সুরক্ষা ও মর্যাদার ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। 


অথচ ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে এরকম যেকোনো অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের সুরক্ষা প্রদানের বিষয়টি এ ধরনের সনদের অন্যতম প্রধান দিক হয়ে থাকে। আমাদের ইতিহাসেও এটি প্রথম নয়। ১৯৭৩ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি করে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যারা যে কাজই করেছে, তার জন্য তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না, যদিও অন্য সময় হলে সেগুলোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ইন্ডেমনিটির সময়সীমা শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস নয়, যুদ্ধ শুরুর আগে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের পরেও ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। 


নানা মহল থেকে জুলাই অভ্যুত্থানকে এখনই প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জুলাই সনদে যদি বিপ্লবীদের সুরক্ষার ব্যাপারে নিশ্চয়তা না দেওয়া হয়, তাহলে আগামীতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হয়ে যাওয়া ঘটনাবলিকে কূটচালের মাধ্যমে অন্যভাবে উপস্থাপন করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করা হবে।


পাশাপাশি, খসড়া সনদে জুলাই অভ্যুত্থানকে দেশের ত্রাণকর্তা রূপে পরিচিত করা হলেও যারা অভ্যুত্থান সফল করতে যেয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, যারা অঙ্গ হারিয়েছে আহত হয়েছে, যারা জীবন বাজি রেখে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের মর্যাদার ব্যাপারে কোনোরকম কথা বলা হয়নি। তারা কি ‘বিপ্লবী’, নাকি ‘জুলাই যোদ্ধা’ না অন্য কোন নামে পরিচিত হবে এ ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। কিংবা যারা শহীদ বা আহত হয়েছে তারা কোন খেতাব বা রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাবে কিনা এ ব্যাপারে কোন আলোকপাত করা হয়নি। 


খসড়া জুলাই সনদকে একটি অঙ্গীকারনামা হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সেখানে সংস্কার গুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নেয়ার কথা বলা হলেও জুলায়ে গণহত্যাকারীদের বিচারিক কার্যক্রম যে নির্বাচিত সরকারের সময়ও চালু রাখতে হবে সে বিষয়ে কোন অঙ্গীকার নেয়া হয়নি। 


পুরো জুলাই সনদের খসড়া শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলোর অঙ্গীকারনামায় পরিণত হয়েছে। যে বিপ্লবের সনদ হিসেবে এটিকে বলা হচ্ছে, সেই বিপ্লবের স্পিরিট এখানে একেবারে অনুপস্থিত। আপনারা যদি মনে করেন, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ডিঙিয়ে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অঙ্গীকারনামা আদায় করবেন, তাহলে এটা আগের অকেজো সংস্কারগুলোর মতই হয়ে যাবে। দেশের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না।

নবীনতর পূর্বতন

Smartwatchs