আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন হাসিনা, যাত্রাবাড়ীতে একদিনেই হত্যা ৫২

 BV LIVE NEWS 

প্রতীকী ছবি © সংগৃহীত

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিরাপত্তাবাহিনীকে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন—সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি ফোনকলের অডিও থেকে এমনটাই জানা গেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিশেষ ইউনিট বিবিসি আই ওই অডিও ভেরিফাই করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

অডিওটি চলতি বছরের মার্চে অনলাইনে ফাঁস হয়। সেখানে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি নিরাপত্তাবাহিনীগুলোকে আন্দোলনকারীদের ওপর ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের’ নির্দেশ দিচ্ছেন। অডিওতে হাসিনা আরও নির্দেশ দেন, আন্দোলনকারীদের ‘যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করবে।’

অডিওটি ইতোমধ্যে ফরেনসিক বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইয়ারশট’ পরীক্ষা করে জানিয়েছে, এতে কোনো এডিট বা কারসাজির প্রমাণ নেই। রেকর্ডিংটি ‘প্রামাণ্য’ ও ‘স্বাভাবিক’ বলে বিবেচনা করছে ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের তদন্তকারীরাও।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের—যেখানে হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারকাজ চলছে—কৌঁসুলিরা তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে এই রেকর্ডিংকে উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করছে। জাতিসংঘের তদন্তকারীদের মতে, গত বছরের আন্দোলনের প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হাসিনা এবং তার দল তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আওয়ামী লীগের দলের এক মুখপাত্র বলেছেন, ওই অডিও টেপে কোনো ‘অবৈধ উদ্দেশ্য’ বা ‘অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার’ প্রমাণ মেলে না। শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর অনুমতি দিয়ে শেখ হাসিনা যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হলো অজ্ঞাত পরিচয় এক শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে হাসিনার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া এই অডিও।

কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাইয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়। পরে শিগগিরই এটি গণ-আন্দোলনে রূপ নেয় এবং দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ছিল এটি।

এই আন্দোলনে ৫ আগস্ট সবচেয়ে রক্তাক্ত দৃশ্য দেখা যায়। সেদিন বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকায় হাসিনার সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ার আগমুহূর্তে তিনি হেলিকপ্টারে পালিয়ে যান। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের তদন্তে ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অপ্রকাশিত কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে, মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল বলে প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ওই কলটি হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে করেছিলেন গত বছরের ১৮ জুলাই। ওই সময় ছিল বিক্ষোভের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কলটির পরের কয়েক দিনে ঢাকায় সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এমন রাইফেল সারা ঢাকায় মোতায়েন ও ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিবিসি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পুলিশের একাধিক নথিতে বিষয়টি উঠে এসেছে।

বিবিসির পর্যালোচনাকৃত রেকর্ডিংটি শেখ হাসিনার একাধিক ফোনকলের একটি। বাংলাদেশের সরকারি টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সংস্থা ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)’ এই কলগুলো রেকর্ড করেছিল। এ বছরের মার্চের শুরুতে ফাঁস হয় কলটির অডিও, তবে কে ফাঁস করেছে তা স্পষ্ট নয়। বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে হাসিনার একাধিক ফোনকলের ক্লিপ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে, যেগুলোর অনেকগুলোই যাচাই করা হয়নি।

বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে ১৮ জুলাইয়ের ওই অডিও রেকর্ডিংটি শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মেলানো হয়েছে। বিবিসি নিজস্ব তদন্তেও অডিওটি যাচাই করেছে। অডিও ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান ইয়ারশট (Earshot) রেকর্ডিংটি পরীক্ষা করে দেখেছে, এতে কোনো এডিট বা কৃত্রিম হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

ইয়ারশট জানায়, অডিওটি সম্ভবত এমন একটি কক্ষে রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ফোনকলটি স্পিকারে চালানো হচ্ছিল। কারণ এতে নির্দিষ্ট ধরনের টেলিফোনিক ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড রয়েছে। এতে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সির (ইএনএ) উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতির মধ্যে হস্তক্ষেপ করা হলে এই ইএনএ অডিওতে উপস্থিত থাকে, এবং এটা প্রমাণ করে অডিওটি পরিবর্তন করা হয়নি।

ইয়ারশট হাসিনার কথোপকথনের ধ্বনি, উচ্চারণ, নিশ্বাসের শব্দ এবং স্বর ভঙ্গি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, রেকর্ডিংয়ে কোনো কৃত্রিম শব্দ নেই। এই বিষয়ে ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বিবিসিকে বলেন, ‘এই রেকর্ডিংগুলো তার ভূমিকা প্রমাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো স্পষ্ট, যথাযথভাবে যাচাই করা হয়েছে এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারাও সমর্থিত।’ ক্যাডম্যান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে চলা মামলার পরামর্শক।

আওয়ামী লীগের এক মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ‘বিবিসি যে রেকর্ডিংয়ের কথা বলছে, তা আমরা সত্যতা যাচাই করতে পারছি না।’

শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক সরকার ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তাকে বিক্ষোভকারীদের হত্যা-অভিযানে সম্পৃক্ত হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ২০৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৩ জন বর্তমানে কারাগারে।

বিবিসি আই ৩৬ দিনব্যাপী বিক্ষোভে পুলিশের আক্রমণের শত শত ভিডিও, ছবি এবং নথি বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত তুলে এনেছে। তদন্তে দেখা গেছে, ৫ আগস্ট ঢাকার ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হন—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ পুলিশ সহিংসতা। ঘটনার সময়কার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ৩০ জন নিহতের কথা বলা হয়েছিল। বিবিসির তদন্তে ওই হত্যাকাণ্ড কীভাবে শুরু ও শেষ হয়, সে বিষয়ে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মোবাইল ফুটেজ, সিসিটিভি এবং ড্রোন চিত্র ব্যবহার করে বিবিসি আই নিশ্চিত করে সেখানে সেনা সদস্যরা পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল। তারা সরে যাওয়ার পরপরই পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে পুলিশ দৌড়ে পালাতে থাকা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। শেষ পর্যন্ত তারা একটি সেনা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ঘটনার ঘণ্টা কয়েক পর বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী থানায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পাল্টা হামলায় ছয় পুলিশ সদস্য নিহত হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের এক মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, গত বছরের জুলাই ও আগস্টের সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘বিচারের অপেক্ষায় থাকা এসব ঘটনার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে যুক্ত থাকার দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ পুলিশ এই সব বিষয়ে নিরপেক্ষ ও গভীর তদন্ত করছে।’

গত মাসে শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যার নির্দেশ, সাধারণ নাগরিকদের ওপর সহিংসতা, উসকানি, ষড়যন্ত্র ও গণহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশের অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত এখনো তাকে দেশে ফেরত পাঠায়নি। শেখ হাসিনার দেশে ফিরে বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান টবি ক্যাডম্যান।

আওয়ামী লীগের দাবি, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে তাদের নেতারা দায়ী নন। দলের এক মুখপাত্র বলেন, ‘দলের কোনো জ্যেষ্ঠ নেতা, এমনকি শেখ হাসিনা নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সহিংসতার নির্দেশ দিয়েছেন বা দায়িত্বে ছিলেন—আওয়ামী লীগ এমন দাবি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মন্তব্য চেয়ে বিবিসি যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পায়নি। 

নবীনতর পূর্বতন

Smartwatchs