নিহত বাসচালক জুলহাস উদ্দিনের বোন ময়নার আহাজারি।
‘আমার ভাইডারে কেডা কেডা আগুন দিয়ে পুড়াইয়া মারলো গো, আমার ভাইডার ওপরে কার এরুম নজর পড়লো গো? আমার ভাইডারে মাইরা পরিবারডারে ধ্বংস কইরা দিলোরে। এখন আমারে কেডা ময়না কইয়া ডাকবো গো, কেডা আমার মারে এহন খাওয়াইবো গো?’ এভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া বাসচালক জুলহাস উদ্দিনের বোন ময়না। আজ মঙ্গলবার দুপুরে নিহত জুলহাসের (২৫) বাড়িতে গেলে তার বোনকে বুকফাটা আর্তনাদ করতে দেখা যায়।
ভাই হারানো ময়না বলেন, ‘আমি কারে ভাই ডাকমু গো, আমার মারে কেডা দেখবো গো..., আমার ভাইয়ের খুনিরাতো যার যার মার বুহো গেসেগা গো, বউয়ের বুগোলো গেসেগা গো, আমার ভাইতো বাড়িত আইবার পারলো না গো। আইন্নেগর কাছে আমি বিচার চাই গো। আইন্নেগর পায়ে ধইরা, আতে ধইরা কই গো, আইন্নেরা আমার ভাইয়ের খুনির বিচার করুইন গো।’
বাসচালক জুলহাস উদ্দিন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারের অভিভাবককে হারিয়ে পাগলপ্রায় বোন ও মা। ময়না আর্তনাদ করতে করতে বলেন, ‘আমরা অইসি নিরহ (নিরীহ) মানুষ গো, আংগর কোনো বাপো নাই গো, বড় ভাইও নাইকা গো, বড় বোনও নাইকা গো। আমরা তিনডা ভাই বোন আছিলাম গো। বড় বইনডা ৭-৮ বছর আগে মইরা গেসে গো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের খুনিগরে ধইরা ফাঁসি দিবাইন গো, না পাইলে আমার হাতে তুইল্লা দিবাইন গো, আমি নিজের হাতে তারে মাইরা দরকার পড়লে আমি জেল খাটবাম গো। এরপরেও আমার ভাই এর খুনি চাই গো।’
পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ফুলবাড়িয়া পৌর শহরের ভালুকজান কৈয়ারচালা এলাকার বাসিন্দা জুলহাস উদ্দিন ‘আলম এশিয়া পরিবহন’-এর চালক ছিলেন। সোমবার দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি ভালুকজান ইসলাম পেট্রোল পাম্পের কাছে পার্ক করা ছিল। রাতে চালক জুলহাস বাসের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় হঠাৎ করেই একদল দুর্বৃত্ত এসে বাসটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান জুলহাস।
তবে বাসের ভেতরে থাকা এক নারী ও তার ছেলে দ্রুত জানালা ভেঙে বের হন। তারা বর্তমানে ঢাকার নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি।
খবর পেয়ে ফুলবাড়িয়া থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং বাসের ভেতর থেকে জুলহাসের দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করেন।
নিহত জুলহাসের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার সমকালকে বলেন, মাত্র এক বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। দীর্ঘ দিন হেলপার হিসেবে কাজ করেন জুলহাস। গত পাঁচ মাস ধরে বাসের চালক হিসেবে তিনি কাজ করছিলেন।
জুলহাসের উপার্জন দিয়েই সংসার চলত। ৫ শতাংশের একটি ভিটেমাটি ছাড়া তাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে স্ত্রী জাকিয়া বাকরুদ্ধ। তার স্বামী ও পরিবারের স্বপ্নগুলো যেন পুড়ে যাওয়া বাসটির মতোই ছাই হয়ে গেছে।
ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান সমকালকে বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে তিনজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি পেট্রোল দিয়ে বাসটিতে আগুন দেয়। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ হাতে পেলেও কাউকে এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করবে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।