‘মোবাইলে কোরআনের অ্যাপ রাখা মানে যে শিবির, সেদিনই প্রথম জানলাম’

BV LIVE NEWS 
.                                     প্রতীকী ছবি © টিডিসি

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. আখতারুজ্জামান ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। মানবাধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার-টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ’—কে দেওয়া এক জবানবন্দিতে এ সব কথা বলেছেন তিনি।  


শনিবার (২৮ জুন) ‘সোচ্চার-টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ’—এর ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তাকে নির্যাতনের ঘটনাটি তুলে ধরা হয়। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য ওই পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:  


২০১৮ সালের ৬ আগস্ট আমি প্রথম জানতে পারি, ফোনে কুরআনের অ্যাপ রাখা মানে শিবির করা এবং এইটা গুম করে ফেলার মতো একটা অপরাধ। অথচ দুনিয়ার এমন কিছু নাই যেটাতে আমি জয়েন করিনি। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিলাম। তারচেয়েও ভালো ছিলাম কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজে। স্কুল লাইফে যুক্ত ছিলাম বক্তৃতার সাথে। ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আমার উপস্থিতি ছাড়া স্কুলে কিছুই হতো না।  



এইচএসসির পর আমি ঢাকায় চলে আসি কোচিং করার জন্য। সফলতাও আসে। কুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বুটেক্স চান্স মোটামুটি সবখানেই পেয়েছিলাম। তবে যেহেতু পোশাক শিল্পে আগ্রহ ছিল, তাই সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ভর্তি হলাম বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বুটেক্সে। আমার ডিপার্টমেন্ট ছিল ওয়েট প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং। 


কলেজ যেখানে শেষ করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলো ঠিক সেখান থেকেই। স্কুল কলেজেই সবকিছুর সাথে যুক্ত থাকা আমি এবার পাখা মেললাম ইউনিভার্সিটির মুক্ত আকাশে। তখনও জানি না, এই ওড়াই হতে যাচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক ভুল। তখনও বুঝিনি, ইউনিভার্সিটির আকাশ স্বাধীন না। বরং এই স্বাধীন আকাশের পদে পদে পেতে রাখা আছে জীবন হন্তারক এক ফাঁদ। যে ফাঁদের নাম, ছাত্রলীগ।


ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই চেষ্টা করেছি প্রতিটা রিসোর্স ঠিকঠাক ইউজ করতে। ফলে আমাদের ক্যাম্পাসের প্রায় প্রতিটা অর্গানাইজেশন আর ক্লাবেই ছিল আমার অবাধ বিচরণ। এই বিচরণের কারণেই আমি হয়ে পড়ি ছাত্রলীগের অতি সহজ এক শিকারে। 


ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সিআরের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। আমার হল ছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম হল। বিশেষ কিছু কারণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম হল ছিল বুটেক্সের বাকি হলগুলো থেকে আলাদা। কারণ এটাই একমাত্র হল ছিল, যেখানে ছাত্রলীগের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। হলের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রভোস্ট আর সহকারী প্রভোস্ট এর হাতে। আমরা সবাই এই হলে উঠেছিলাম বৈধভাবে, প্রশাসনকে টাকা দিয়ে। যা ছাত্রলীগ কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। 


কারণ অন্যান্য হলে এই টাকাগুলো ছাত্রলীগ নিতো। সিট বাণিজ্য করতো, হলের সিটের লোভ দেখিয়ে ছেলেদের ইউজ করতো। কিন্তু সৈয়দ নজরুল হলে সেই সুযোগটা তারা পাচ্ছিলো না। ফলে, এই হলের উপর ছাত্রলীগের পোলাপাইনের রাগ একটা ছিলই। সেই রাগ দ্বিগুণ হয়ে যায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। কুর্মিটোলায় বাসচাপায় মারা গেল দুইজন শিক্ষার্থী। ক্ষোভে ফেটে পড়ল সারাদেশ। সেই ক্ষোভ যাত্রায় অংশ নিলো বুটেক্সও। 


ছাত্রলীগের বিভিন্ন বাঁধা, ভয়ভীতি আর হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে আমরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলি। আর বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে যুক্ত থাকার কারণে আন্দোলনের জন্য ডাকাডাকি বা মোটিভেশনের কাজটা আমাকেই করতে হতো। কাজেই, ছাত্রলীগ আমাকে তাদের জন্য থ্রেট ভাবতে শুরু করে। এবং আমার উপর নজর রাখতে শুরু করে। তার উপর আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম হলের ছাত্র, যেখানে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ নেই— এটাও বড় একটা কারণ ছিল।



আমাদের উপর ছাত্রলীগের রাগের আরো একটা কারণ ছিল, উনাদের রাজনৈতিক প্রোগ্রামে আমরা যেতাম না। মাঝেমধ্যেই ওরা আমাদের র‍্যাগ দেওয়ার জন্য ওসমানী হলে ডাকতো। কিন্তু আমরা কোনোদিনই সেই ডাকে সাড়া দিইনি। ফলে, তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল আলম সাকিব আর সেক্রেটারি মাইনুল ইসলাম লিঙ্কন আমাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। কয়েকবার অন্য হল থেকে লাঠি-সোঁটা আর স্ট্যাম্প নিয়ে ভারতে পর্যন্ত এসেছিল। যদিও পরবর্তীতে সেসব মিটমাট করে ফেলা হয়। 


এমনিই এক পরিস্থিতিতে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে একটা খবর ছড়িয়ে পড়ে। যে আওয়ামী লীগগ অফিসে এক মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো বাংলাদেশ। আমরা তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ শুরু করি। 

২০১৮ সালের ৬ আগস্ট বাংলাদেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক দিন। 


এই দিনই প্রথম বহু ছেলে-মেয়ে ছাত্রলীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে পোস্ট দিতে শুরু করে । এই দৃশ্য দেখে আওয়ামী লীগগ আর ছাত্রলীগের মাথা বিগড়ে যেতে থাকে। এরা তখন সবাইকে শিবির ট্যাগ দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। বাট তাতে কোন লাভ হয় নাই। বরং ছাত্রলীগের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাই। 


রাগে ক্ষোভে অন্ধ ছাত্রলীগ সবাইকে র‍্যাগ রুমে ডেকে পাঠায়। এমন সবাইকে গণহারে মারতে থাকে। আর সবাইকে শিবির বলে গালিগালাজ করতে থাকে। বিশেষ করে টার্গেট করা হয় আমাদের চারজনকে।যার মধ্যে তিনজনই আমার সিনিয়র, আমি তাদের জুনিয়র। 


ফজরের পর আমাদের ডাকা হয়। গিয়ে দেখি আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত হয়েছে। এই নির্যাতনে মূলত লিড দিয়েছিল ফাহাদ হাসান আর দিপ্ত নন্দী। সাথে ছিল সাজ্জাদ শাওন। এরা আমাদের উপর সবাই মিলে নির্যাতন শুরু করে। আমাদের এক সিনিয়র ভাইয়ের কান মুখ ফাটিয়ে ফেলা হয়। উনার সেই সমস্যা উনি এখনও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। 


আমাদের সবাইকে স্ট্যাম্প, রড আর জি আই পাইপ দিয়ে পেটানো হয়। এমনকি মার খেতে খেতে কেউ পড়ে গেলে, তাকে ঐ ফ্লোরে পড়ে থাকা অবস্থাতেই পেটানো হচ্ছিলো। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো করে। 


সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো,আমাদের মধ্যে এক ভাইকে মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন করা হয়। কারণ ছিল কী জানেন? উনি নিয়মিত নামাজ কালাম বেশি পড়তেন, তাই। হ্যা, ৯০ পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে নামাজ কালাম পড়াও এতো বড় অপরাধই ছিল।

এরপর ফোনের মেসেজ চেক করে দেখে ঐ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। তখন আমাকেও প্রশ্নটা করা হয়, আমি শিবির করি কি না? না বলার সাথে সাথে আমাকে ওরা আবার মারতে শুরু করে। প্রথমে পেটায় আমার পায়ে। আমি পড়ে গেলে আমার উপর চলতে থাকে এলোপাথাড়ি মার। 


আমার ফোন চেক করে কুরআন হাদিসের অ্যাপস আর অডিও পাওয়ার অপরাধে আমাকেও আর ছাড়া হলো না। বরং আমাদের চারজনকে আটকে রেখে র‌্যাব ২ এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। বলা হয় আমরা আন্দোলন উসকে দিচ্ছি। প্রায় সন্ধ্যার সময় র‌্যাব এসে আমাদের তুলে নিয়ে যায়। চোখ বেঁধে বেঁধে আমাদের গাড়িতে তোলা হতে থাকে। পরে আবিষ্কার করি, চারজনকে ওরা এক গাড়িতে নেয়নি। এক গাড়িতে তিনজন। আরেক গাড়িতে নিয়েছে একজনকে। আমি ছিলাম তিনজনের দলে। 


চোখ বাঁধা থাকায় কোথায় যাচ্ছি, বা কোথায় আছি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমাদের ক্রমাগত প্রশ্ন করা হচ্ছিলো। আমাদের সাথে আর কে আছে, কে আমাদের লিড দিচ্ছে, হ্যান ত্যান। আমরা সত্যিই কিছুই জানতাম না, কিন্তু সে কথা এদের বিশ্বাস করাবো কেমনে? 


ওদিকে তুলে নেওয়ার পর সবার ফ্যামিলির পলিটিক্যাল ব্যাকাপ চেক করা হয়। যেহেতু আমার ফ্যামিলির সাথে বিএনপির পলিটিক্যাল যোগসূত্র ছিলো, সেহেতু আমি আরো বেশি বিপদে পড়ে যাই। এভাবে দুই ঘণ্টা আমরা গাড়িতে ছিলাম। এই দুই ঘণ্টার প্রতিটা মিনিট আমার জন্য ছিল জাহান্নামের মতো। একদিকে গুম হয়ে যাওয়ার ভয়, আরেকদিকে ফ্যামিলি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছিলো আমাদের প্রতিটা মিনিট।


ওদিকে আমাদের না পেয়ে আমার ফ্যামিলি পাগলের মতো আমার খোঁজে ছুটে চলছিলো থানা থেকে থানা। আমার মা বাবা ধরে নিয়েছিলো, আমি মারা গেছি। তখন হাসিনার রমরমা গুমের সময়। আমাদের ফ্যামিলির এই ভয়ের পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। 


আমি চাই না আমার শত্রুকেও কখনও এই ভয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হোক। ৭ তারিখ মধ্যরাতে তারা আবার আমাদের গাড়িতে তোলে। এবার আর চোখ বন্ধ করেনি। পাশের শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দেখে বুঝতে পারি, আমাদের মূলত র‍্যাব-২ এর কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। হাসিনা পালানোর পর যেখানে আয়নাঘর আবিষ্কৃত হয়। আমাদের এরপর নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডি থানায়। ওখানে আমাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।।


পুলিশ আইসিটি আইনের ৫৭ এর ২ ধারা মোতাবেক আমাদের নামে মামলা করে। জেলে আমাদের তিনজনকে একসাথে রাখা হয় অন্যজনকে রাখা হয় আলাদা জেলে। কোর্ট আমাদের দুই দিনের রিমান্ড দেয়। রিমান্ডে পুলিশ আমাদের উপর মানসিক নির্যাতন করলেও গায়ে হাত দেয়নি। তবে রিমান্ডে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে আমাদের ফ্যামিলির কাছে থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। ঐ সময় আমাদের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার ছিল দেবরাজ, ধানমন্ডি থানার। এরপর আমাদের কেরানিগঞ্জ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা ছিল আমাদের জন্য আরো একটা কঠিন অধ্যায়। 


তবে কেরানিগঞ্জে আমি মোটামুটি সব ক্যাম্পাসের ছেলেদেরই পেয়েছিলাম। এমনকি আন্দোলনে পানি দিয়েছে, এমন লোকজনকেও ওরা রেহাই দেয়নি। তুলে এনেছে। সেমিস্টার ফাইনাল আমি জেলে বসেই দিই। দুই মাসের মতো থাকার পর আমি ১২ অক্টোবর জেল থেকে ছাড়া পাই। তবে আমাদের জেলে পাঠানোর পেছনে ওদের সব উদ্দেশ্যই সফল হয়েছিল।

আমাকে হল ছাড়তে হলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হলও ছাত্রলীগের দখলে চলে গেল। এরপর আমার আর হলে থাকা হয়নি। 


আমার শিক্ষকরা আমার প্রতি যথেষ্ট হেল্পফুল ছিলেন। কেসের হাজিরা দিতে গিয়ে পরীক্ষা মিস হতো অনেক সময়, তখনও উনারা আমাকে সহযোগিতাই করেছেন। বন্ধুরা প্রথমে অনেক ভয় পেলেও পরে ঠিকই সামলে নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। 

তবে আমার গুম হওয়ার কথা শুনে আমার পরিবারের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এই ধাক্কাটা উনি সামলাতে পারেননি। 


আর এই ঘটনার পর দেশ নিয়ে আমার সমস্ত আশা, ভালোবাসা আর অনুভূতির মৃত্যু ঘটে। ছোটবেলা থেকেই আমি দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষ। অথচ এই ঘটনার পর অনেক চেষ্টা করেও দেশ নিয়ে আর কোন স্বপ্ন আমি দেখতে পারিনি। দেশের জন্য আর কোনো পরিকল্পনা আমি করতে পারিনি। দেশকে ভালোবাসতে পারা একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে পবিত্র অনুভূতি। বুটেক্স ছাত্রলীগ আমার সেই অনুভূতিকে আমার কাছে থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে। মানুষ খুনের বিচার আছে, অথচ এই স্বপ্ন খুনের কোন বিচার হয় না কেন?

নবীনতর পূর্বতন

Smartwatchs